আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃতীসন্তান, চিৎপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আধিকারিক

বিশেষ প্রতিবেদন,সঞ্জীব পাল : উত্তর কলকাতার চিৎপুর থানা অঞ্চলে রয়েছে অনেকগুলি বড় বড় গোডাউন,হঠাৎ হওয়া লকডাউনের ফলে, বেশকিছু ভিনদেশি ও আদিবাসী শ্রমিক আটকে পরে সেখানে। গোডাউন মালিকেরাও তাঁদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে,ফলে না খেতে পেয়ে, চরম দুর্ভোগে দিন কাটছিল গোডাউনে আটকে পরা ভিনদেশি শ্রমিকদের। এই খবর পেয়েই, কিছু খাদ্যসামগ্রীসহ চিৎপুর থানার এক আধিকারিক, পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হন গোডাউনগুলিতে। সারাদিন ধরে ওই আধিকারিক চিৎপুর এলাকার প্রত্যেকটি গোডাউন পরিদর্শন করেন ,তৈরি করেন আটকে পড়া শ্রমিকের তালিকা। ফিরে এসে থানার বড়বাবু অয়ন ভৌমিকের পূর্ণসহায়তায় ওই তালিকা তুলে দেন বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাতে।তারপর থেকে তার নজরদারিতেই চালু ছিল ওই বিশাল সংখ্যক ভিনদেশি শ্রমিকদের রোজকার খাওয়াদাওয়া ব্যাবস্থা। পরে তাদের বাড়িতে ফেরার ব্যাবস্থাও তিনিই করেছিলেন। এই বিশাল মানবিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেওয়া,সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওই মানুষটি হলেন উত্তর কলকাতার চিৎপুর থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আধিকারিক শ্রী চৈতান চাপিয়ার।
আরো পড়ুন: নেশায় পক্ষীপ্রেমী চিত্রগ্রাহক,পেশায় কলকাতার পুলিশ আধিকারিক
১৯৭৪ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানার কৈলিশুতা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত সাঁওতাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চৈতান চাপিয়ার। বাবা ইছাপুর গান শেল ফ্যাক্টরীতে কর্মরত ছিলেন। শাল পিয়ালের মাঝে বড় হওয়া ,ছোট থেকেই ফুটবল অন্তঃপ্রান চৈতান মাত্র ৩ বছরে বয়সে সপরিবারে স্হানাস্তরিত হয়ে চলে আসেন নদীয়ার মদনপুরে। গ্রামের তেঘরি প্রাইমারি স্কুলে পড়া শেষ করে ভর্তি হন বর্দ্ধমান সেক্রেট চার্চ বোরডিং স্কুলে। পড়াশোনার খাতিরে হোস্টেলে বড় হওয়ায়, তেমনভাবে পাননি বাবামায়ের আদরযত্ন । ১৯৯৯ সালে জীবনের প্রথম চাকরি পান রেল পুলিশে । কিন্তু তার স্বপ্ন যে কলকাতা পুলিশ এবং ফুটবল, তাই মন বসেনা এই চাকরিতে। চেষ্টার পাশাপাশি চলতে থাকে ফুটবল অনুশীলন। ওই বছরের শেষেই সূযোগ আসায়, চৈতান যোগদান করেন কলকাতা পুলিশের সহ আধিকারিক রুপে। তবে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের ইতি হতে দেননি তিনি । সূযোগ পেলেই মদনপুর এলাকার এভেন গাঁওতা নামে একটি ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতেন তিনি। এখন তিনি ওই ক্লাবেরই কর্মকর্তা। বেশিরভাগ সাঁওতাল ও পিছিয়ে পরা সম্প্রদায়ের ছেলেপুলেদের নিয়েই চলছে ক্লাবটি । হোস্টেলের খ্রিস্টান কালচারে বড় হওয়া, চৈতান কিন্তু কখনওই তার মন থেকে হারিয়ে যেতে দেননি তার নিজস্ব সাঁওতালি সত্তাকে , তাই এখনো তার বর্তমান নিবাস মদনপুরে বুক দিয়ে আগলে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার নিজস্ব সাঁওতালি সংস্কৃতিকে । তার অঞ্চলে মারাং বুরুর পুজো, সহোরাই,বাহা উৎসব, নাটক ও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একত্রীত করে রাখেন শহরে বসবাস করা, নিজের সম্প্রদায়ের মানুষজনকে। এখনো সম্প্রদায়ের রেওয়াজ অনুযায়ী যে কোন বিষয়ে মেনে চলেন তাঁদের মাঝির ( মোড়ল ) নির্দেশ। নিজের মুখেই জানালেন তার ইচ্ছের কথা। রিটায়ার্ডমেন্টের পরে নিজের গ্রামে ফিরে শাল,পিয়াল ও মহুয়ার মাঝে প্রাণ ভরে বাঁচতে চান নিজের সম্প্রদায়ের সঙ্গে। টুমডাক্, তামাক ও মাদলের তালে তালে পালন করতে চান সাহোরাই, বাহা,কারাম, সাক্রাত,মাহমোরে, ও মাঘসিমের মতো সাঁওতালি উৎসবগুলি। সম্প্রদায়ের সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ,তাঁদের নতুন প্রজন্মকে তুলে ধরতে চান উন্নতির আলোর দিকে। তার স্বপ্ন একটাই , গ্রামে একটা ফুটবল খেলার ক্লাব করে, সুপ্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের তুলে ধরা। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে আদিবাসী সমাজের এক প্রকৃত আদৰ্শ হয়ে পুলিশ আধিকারিক শ্রী চৈতান চাপিয়ার, তারই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গর্ব রূপে আজ কর্তব্যরত রয়েছেন কলকাতার চিৎপুর থানাতে।