পুলিশের ডাইরি

যে আমি আত্মহত্যার সুখ কল্পনায় ভাসি, সেই আমিই আবার সম্মুখ যুদ্ধে বেঘোরে প্রাণ দিতে অস্বীকার করি। কখনো পালিয়ে বেড়াই। আবার কখনো সময় সুযোগ পেলে তীব্র ক্ষোভে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। উদ্দেশ্যহীন দুনিয়ায় কখনো কখনো আবার এই মানুষগুলোকে নগন্য কীটের মত মনে হয়, তখন সব ক্ষোভ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর যখন বুঝতে পারি আমিও আসলে কীটের চাইতেও নগণ্য, তখন অসহায় লাগে। মানুষ তার হাতে তৈরি সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি নৈতিকতা, জ্ঞান বিজ্ঞানের দাস হয়ে উন্নত হচ্ছে, অবনত হচ্ছে, ভালোবাসছে, ঘৃণা করছে, একে অপরকে বাঁচাচ্ছে, মারছে – এ সমস্তকেই অনর্থক মনে হয়। কীটের জীবন, প্রাণীর জীবন, গাছের জীবনকে বড় আকর্ষণীয় মনে হয়। ওদের বেঁচে থাকায় সভ্যতার কোনো দায় নেই, নেই কোনো বোঝা। সেই আদিম, বন্য, অসভ্য মানুষের জীবনকে আকর্ষণীয় মনে হয়। সভ্য হতে গিয়ে মানুষ কত কি যে হারিয়েছে মানুষ কি তা জানে?
বেঁচে থাকা যদি অর্থহীন হয় তাহলে মৃত্যুও অর্থহীন। অথচ আমরা মৃত্যুকে জয় করতে চাই। কারণ আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। শুধু মৃত্যুভয়ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেনা, সে বেঁচে থাকার অর্থও খোঁজে, উদ্দেশ্যও খোঁজে। প্রাত্যহিক ছোট ছোট নানা কিছুর মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ায়। বেঁচে থাকা অনেকটা সংগ্রামের মত। অনেকের কাছে এই সংগ্রামে প্রতিনিয়ত জয়ী হওয়াটাই জীবনের উদ্দেশ্য। অনেকের কাছে একটা সম্পর্কই হয়তো তার জীবনের উদ্দেশ্য। অনেকের কাছে ছোট ছোট সুখ, হাসি কান্না ইত্যাদি জীবনের উদ্দেশ্য। অনেকের কাছে সঞ্চয় জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে অপচয়। অনেকের কাছে সংসারই জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে বৈরাগ্য। অনেকের কাছে শাসন শোষণ জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে নত হওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য। অনেকের কাছে কেরিয়ার তৈরি জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছ জীবনের উদ্দেশ্য বহুজন হিতায়ঃ বহুজন সুখায়ঃ।
আমি শান্তির বানীকে ঘৃণা করি, আমি ধ্বংসকে ভালোবাসি। আমি জানি যাবতীয় যুদ্ধের মূলে আছে শান্তি নামক প্রতারণা। কখনো আমি ধ্বংস কামনা করি সমাজ সভ্যতার, অসাম্যের, ভেদাভেদের। তখন আমি মৃত্যুকেও ভালোবাসি। মৃত্যুর সাথে সাথে সমাজ, সভ্যতা, অসাম্য, ভেদাভেদ সবেরই সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু হাসিকান্নার জন্য, ভালোবাসার জন্য, ঘৃণা করার জন্য, সৃষ্টি করার জন্য, ধ্বংস করার জন্য, এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যেও অন্তত বেঁচে থাকতে হয়। তাই আমি বেঁচে থাকতেও ভালোবাসি। এবং সেই কারণেই হয়তো বেঁচে থাকি।
সত্যি কথাটা হল, প্রায় প্রতিটি ব্যক্তিই একই সাথে বেঁচে থাকতে ও বেঁচে না থাকতে ভালোবাসেন!
(লেখক:সায়ন্তন মিত্র, কলকাতা পুলিশে কর্মরত)